চীনের মহা প্রাচীর বা, গ্রেট ওয়াল অব চায়না!! দীর্ঘ এ প্রাচীরের
সারি প্রায় পুরোটাই মাটি ও পাথর দিয়ে নির্মিত। পৃথিবীর সপ্তাশ্চর্যের একটি হল
চীনের এই মহা প্রাচীর। আক্রমণকারীদের দূরে রাখা এবং সামরিক অনুপ্রবেশ ঠেকানোই ছিল
এ বিশাল প্রাচীর নির্মাণের উদ্দেশ্য। এই দেয়াল নির্মাণ করার প্রকল্পটি পৃথিবীর
অন্যতম ব্যয়বহুল এক প্রকল্প হিসেবে ধরা হয়। আজ আমরা পৃথিবীর এই সবচেয়ে দীর্ঘতম
প্রাচীরটির ইতিহাস, বর্তমান
অবস্থা, অবকাঠামো ইত্যাদি সম্বন্ধে জানাব।
চীনের ঐতিহাসিক উত্তরাঞ্চলের
বর্ডারে চায়না রাজ্য এবং রাজত্ব টিকিয়ে রাখার লক্ষ্যে এই প্রাচীরটি নির্মাণ করা
হয়েছিল। এটি বর্ডারের পূর্ব থেকে পশ্চিম দিকের রেখা বরাবর নির্মিত। ইউরেশিয়ান
প্রান্ত থেকে যাযাবর গোষ্ঠীগুলোর যথেচ্ছ আক্রমণ ঠেকাতেই তখন এ পন্থা অবলম্বন করা
হয়েছিল। চীনের প্রাচীর আসলে বেশ কিছু দুর্গের সমষ্টি। চীনের ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায়
একে প্রায়শই ঐতিহাসিকরা দীর্ঘ দেয়াল বলে অভিহিত করে থাকতেন।
কিন রাজ্যের রাজা ঝেং ২২১
খ্রীষ্ট পূর্বে তার শেষ শত্রুদেরও পরাজিত করে পুরো চায়নায় প্রথম ‘কিন’ বংশের
রাজত্ব স্থাপন করেন। তবে উত্তর দিক থেকে জিয়াংনু গোষ্ঠির মানুষদের আক্রমণ থামানো
যাচ্ছিল না। তাই তিনি এ আক্রমণের হাত থেকে রাজ্যকে রক্ষার জন্য অবশিষ্ট
দুর্গগুলোকে সংযুক্ত করে নতুন দেয়াল নির্মাণের নির্দেশ দেন। এ দেয়াল নির্মাণের
কাঁচামাল জোগাড় করা তখন বেশ কষ্টসাধ্য এক কাজ ছিল। তাই স্থানীয় যেসব কাঁচামাল
পাওয়া যেত তাই দিয়েই কাজ চালানো হত। পরবর্তিতে হান, সুই সহ আরো অনেক রাজবংশ এই দেয়ালের
সংস্কার, পুনর্নির্মাণ এবং বিস্তার
ঘটায়।
১৪শ শতাব্দীতে এসে মিং
সাম্রাজ্যের অধীনে চীনের মহা প্রাচীর যেনো নব জীবন লাভ করল। মূলত টুমুর যুদ্ধে
পরাজিত হয়ে তারা এ বিষয়ে সচেতন হয়ে ওঠে। তারা এক প্রকার বাধ্য হয়ে উত্তরের বর্ডারে
আবার দেয়াল স্থাপনের কাজ শুরু করল। তারা আগের মত স্থানীয় মাটি দিয়ে তৈরি না করে এবার
দেয়ালগুলো তৈরি করল পাথর এবং ইট দিয়ে। দেয়ালের উপড় প্রায় ২৫,০০০ টি ওয়াচ টাওয়ার নির্মাণ করা হল।
কিন্তু এতেও মঙ্গোলদের আক্রমণ থামনো গেল না। তারা নিয়মিত আক্রমণ চালাতে থাকল। এর
ফলে নিয়মিত দেয়ালগুলোর বেশ ক্ষতি সাধন হতে লাগল আর মিংদের এর সংস্কারের পেছনে আবার
প্রচুর অর্থ ও শ্রম খরচ করতে হতে লাগল।
১৮৬০ সালে শেষ হওয়া ২য় অপিয়াম
যুদ্ধের পর চায়নার বর্ডার বিদেশিদের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। এর ফলেই ব্যবসায়ী
এবং দর্শনার্থীরা এই মহা প্রাচীর সম্বন্ধে ভালভাবে প্রথম জানতে পারে। এর আগে
পর্যন্ত সারা বিশ্বে এর তেমন কোন পরিচিতি ছিল না। ধীরে ধীরে চীনের এই মহা প্রাচীর
দর্শনার্থীদের আকর্ষণের মূল কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়ে যায়। বিশেষ করে উনবিংশ
শতাব্দিতে এসে এই প্রাচীর খুবই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে |
চীনের মহা প্রাচীর পৃথিবীর
সবচেয়ে বড় সামরিক অবকাঠামো। এটিই মানুষের হাতে তৈরি সবচেয়ে বড় স্থাপত্য। উচ্চতায়
প্রায় ৫ থেকে ৮ মিটার উঁচু এই প্রাচীরটি। আর লম্বায় প্রায় 21,000 কি.মি.!
গ্রেট ওয়্যাল অফ চায়না্, 2007
সালে নতুন সপ্তম আশ্চর্য্য-এর তালিকায় অন্তর্ভূক্ত হয়েছিল। গ্রেট ওয়্যাল অফ চায়না
নির্মাণের সময় দশলক্ষেরও বেশি মানুষ মারা গিয়েছিলেন এবং এটিকে "পৃথিবীর
দীর্ঘতম কবরস্থান" হিসেবে উল্লেখ করা হয়। অগ্নিদ্যূতি ব্যবহার করে একটি
টাওয়ার থেকে আরেকটি টাওয়ারে বার্তা পাঠানো হত। একবার দ্যূতির উন্মোচন মানে 100 শত্রু সংখ্যাকে সূচিত করত, অন্যদিকে দু’বার দ্যূতির উন্মোচন 500 শত্রুর সংখ্যা সূচিত করত।
২০০৯ সালে এই প্রাচীরের
লুকিয়ে থাকা ১৮ কিলোমিটার অংশ নতুন করে আবিষ্কার করা হয়। এই অংশটি পাহাড় এবং খানা
খন্দের আড়ালে চাপা পরে গিয়েছিল। এই অংশ খুঁজে বের করতে ‘ইনফ্রারেড রেঞ্জ ফাইন্ডার’
এবং জিপিএস সিস্টেম ব্যবহার করা হয়েছিল। গত বছরের মার্চ এবং এপ্রিলে আরো ১০ কি.মি.
এরও বেশি দীর্ঘ দেয়ালের অস্তিত্ব পাওয়া
গিয়েছে বলে জানা যায়। এগুলোকেও চীনের মহা প্রাচীরের অংশ হিসেবেই ধারণা করা হচ্ছে।
বর্তমানে
প্রাচীরটির অনেক অংশই ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়ে গেছে। যদিও বেইজিঙ্গের উত্তর দিকে এবং
পর্যটন কেন্দ্রের আশেপাশে সংরক্ষিত রয়েছে। এসবের কিছু অংশ আবার অনেক বেশি রকমের
সংস্কারও করা হয়েছে। ২০১৪ সালে লাইয়াওনিং এবং হেবেই প্রদেশের বর্ডারের কাছের
দেয়ালগুলো কনক্রিট দিয়ে নতুন করে সংস্কার করা হয়। চীন সরকারের এই সংস্কার উদ্যোগ
তখন বেশ সমালোচনার মুখে পড়েছিল। ২০১২ সালের ‘স্টেট অ্যাডমিনিস্ট্রেশান অভ কালচারাল
হেরিটেজ’ কর্তৃক প্রকাশিত তথ্যমতে মিং সাম্রাজ্যের সময় তৈরি হওয়া ২২% প্রাচীরই বা, প্রায় ২,০০০ কি.মি.
প্রাচীরই সম্পূর্ণরুপে ধ্বংস হয়ে গেছে। পৃথিবীর সপ্তাশ্চর্যের একটি এই চীনের মহা
প্রাচীরের যে অংশ গানসু প্রদেশে অবস্থিত তার ৬০ কি.মি. এরও দীর্ঘ অংশ সামনের ২০
বছরের মাঝেই ধ্বংশ হয়ে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
আজ কালের
আবর্তে শুধু চীনের নয় গোটা বিশ্বের গৌরব চীনের এই প্রাচীর আজ অনেকটাই ধ্বংসের
মুখোমুখি। পৃথিবীর সপ্তাশ্চর্য হিসেবে তালিকাভুক্ত হওয়ার পর এর প্রতি চীন সরকার
যেমন যত্নবান হয়েছেন তেমনি উল্টোদিকে এই ব্যাপক পরিচিতির ফলে একে প্রতি নিয়ত
সামলাতে হচ্ছে লাখ লাখ পর্যটকদের চাপ। তবে চীন সরকার যদি এর সংস্কারের প্রতি আরো
মনোযোগী হয়ে ওঠে তাহলে হয়ত আরো বহুদিন এই মনুষ্য সৃষ্ট বিশ্ব ঐতিহ্যকে এই পৃথিবীর
বুকে টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে।
0 Comments